বনফুল কে নিয়ে আমার লেখা ছোট একটি গল্প - পর্ব ৪

যে মানুষের আচরণ ও ধ্যানধারণার স্বরূপ উদ্ঘাটনে বনফুলের সন্ধানী দৃষ্টি জীবনের আরো বহু বিচিত্র দিক নিষ্ঠুর সত্যের আলোকে উজ্জ্বল করে তুলেছে! আমাদের বীরপূজার মোহে আমরা যে নিরপেক্ষ বিচারশক্তিও হারিয়েছি তারই উদাহরণ ‘নাম' গল্পটি। প্রখ্যাতনামা ব্যক্তির সব আচরণ আমরা শুধু ক্ষমার চক্ষেই দেখি না, অনেকটা শ্রদ্ধা-মিশ্র ঔদার্যের সঙ্গেই গ্রহণ করি, নামমোহমুক্ত দৃষ্টিতে সাধারণ মানুষের জীবনে হলে তা তুচ্ছতাচ্ছিল্যেরই উদ্রেক করে। যতীনবাবুর গ্রেটম্যানের গল্পে নামটা চেপে রেখেছেন বলেই মনে হচ্ছে না, নামটা আগে বললে প্রতি পদে গ্রেটনেস দেখতে পাওয়া যেত। প্রকৃতপক্ষে আমাদের সমস্ত বিচার-সিদ্ধান্তই আপেক্ষিক।

'থিওরি অব রিলেটিভিটি' গল্পে তাই তাকে 'পাঁচ পয়সার মোদকের নেশা'র সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। যে নেশার ঘোরে পান্নালাল চক্রবর্তীকে লেখিকা মনে হয়েছে, ট্রাঙ্কের দাম হয়েছে বারো আনা আর জুতো চার আনা, সেই নেশা কেটে যাবার পর দেখা যাচ্ছে প্রসিদ্ধ লেখক পান্নালাল চক্রবর্তী মেয়েমানুষ নন, খোঁচা খোঁচা গোঁফওয়ালা মাড়োয়ারি-সদৃশ স্থূলকায় এক বিরাট পুরুষ; ট্রাঙ্কের দামও বারো আনা নয়, সাড়ে তের টাকা। জুতোও চার আনার নয়, পৌনে সাত টাকায়ই কেনা হয়েছিল। নেশার ঘোরে মানুষ মাত্রেরই অবস্থা সমান হাস্যোদ্দীপক! আমরা সবাই পাঁচ পয়সার মোদকের নেশায় বিহ্বল হয়ে আছি! তাই যে বুড়ি তার ময়লা শতচ্ছিন্ন দুর্গন্ধ কাপড়টা নিয়ে একটু আগেও ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার সবচেয়ে প্রত্যক্ষ কারণ হয়েছিল যখন জানা গেল যে, মাসিমার বাড়ির পুরনো দাই রুমিনিয়া এবং মাসিমার রোগশান্তির কামনায় সে ‘মহাবীরজী’র পূজা চড়িয়ে এসেছে, তখন তার নোংরা দুর্গন্ধ কাপড়ে রাখা মহাবীরজীর প্রসাদ সানন্দে ভক্ষণ করতে আর আপত্তি হয় না। ১ এই 'পাঁচ পয়সার মোদকের নেশা’বশেই বেগম-মণ্ডলী-পরিবৃত সম্রাট সাজাহানের তাজমহলের ঐশ্বর্য-সমারোহে আমরা মুগ্ধ হই, কিন্তু ফকির-সাজাহানের একনিষ্ঠ পত্নীপ্রেমের মহিমা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে না। দুরারোগ্য 'ক্যাংক্রাম অরিস' রোগে তার বেগমের মুখের আধখানা পচে গেছে, ডানদিকের গালটা নেই, দাঁতগুলো বীভৎসভাবে বেরিয়ে পড়েছে, দুর্গন্ধে কাছে দাঁড়ানো যায় না। তবু বৃদ্ধ স্বামী নির্বিকার চিত্তে স্ত্রীর বোঝা পিঠে বহন করে বেড়িয়েছে। করাল মৃত্যুর কবল থেকে তাকে রক্ষা করতে পারেনি, কিন্তু সম্রাটের মত প্রিয়ার সমাধিকে ‘মৃত্যুহীন অপরূপ