চেম্বার কথন: মুখের একপাশ বেঁকে যাওয়া (Bell's Palsy/Facial palsy) এক রুগীর গল্প!
মুখের একপাশ বেঁকে যাওয়া (Bell's Palsy/Facial palsy) এক রুগীর গল্প!
৩৬ বছর বয়স্ক ভদ্রলোক। এখানে একটা ওয়াক্তেও মসজিদের দায়িত্বে আছেন সম্ভবত। আমার কাছে আসার ৪-৫ দিন আগ থেকে লক্ষ্য করছিলেন যে উনার মুখের ডান পাশটা কেমন যেন অবশ অবশ লাগছিল। ডান চোখটা ঠিকমত বন্ধ করা যাচ্ছিল না; সবসময় খোলাই থাকছিল। মুখের বাম কোনার মুভমেন্ট ঠিক ছিল কিন্তু ডান কোনায় কোন নড়াচড়া ছিল না। মুখ হা করলে বাম দিকে বেঁকে যাচ্ছিল! মুখের ভিতরে ডানপাশে খাবার দলা পাকিয়ে জমে যাচ্ছিল। প্রথম ১-২ দিন মুখের ডান পাশ দিয়ে খাবার-পানির কিছু অংশ পড়ে যাচ্ছিল!
Bell's Palys অথবা one-sided facial palsy or paralysis!!
এটা এমন একটা রোগ যেটা মুখে শুনে এবং চোখে দেখেই রোগ নির্ণয় করা যায়। ইতিহাস শুনতে শুনতেই উনার মুখের (Face) নড়াচড়া লক্ষ্য করলাম। ডান চোখ হাঁ করে আছে, চোখের পাতা পড়ছে শুধু বাম চোখে। একটা টিঁস্যু দিয়ে উনি বার বার ডান চোখ মুচছেন! ৪-৫ দিন ধরে অনবরত চোখ খোলা থাকায় একটু একটু করে পানি ঝরছে (যেটা উনি টিস্যু দিয়ে মুচছেন)। কথা বলার সময় লক্ষ্য করলে বোঝা যাচ্ছিল যে মুখের দুই কোনার নড়াচড়া সমান নয়। কপালের ডান পাশ কুঁচকাতে পারছেন না!
ডায়াগনোনিস নিয়ে আর কোন সন্দেহ নাই। উনাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন প্রথম দিনেই আসেন নাই ডাক্তারের কাছে? প্রথমত উনি বিষয়টাকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবেন নাই। দ্বিতীয়ত, উনার এক আত্মীয় আছেন যিনি একটা ফিজিওথেরাপীর এসিস্ট্যান্ট। তিনি রুগীকে কিছু ব্যায়াম শিখিয়ে দিয়েছেন যা করলেই নাকি উনার সমস্যা চলে যাবে।
যাহোক। মেডিকেলে নলেজ অনুযায়ী রুগী বেশ দেরি করে ফেলেছে আসল চিকিৎসা শুরু করার ক্ষেত্রে। সেক্ষেত্রে তার এই ডিফেক্টগুলো ঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে বেশ কিছুটা। যত তাড়াতাড়ি চিকিৎসা শুরু করা যায় পুরোপুরি ভাল হবার সম্ভাবনা তত বেশী থাকে। ৭২ ঘন্টা পার হয়ে গেলে সম্ভাবনা কমতে থাকে চিকিৎসা করা হলেও।
বিষয়গুলো রুগীকে বুঝিয়ে বললাম। যে যে চিকিৎসা দেয়ার আছে দিয়ে বিদায় দিলাম। পুরোপুরি ঠিক হয়েছেন কিনা তা এখনো জানা হয় নাই।
এই গল্পের আলোচ্য রোগ মুখের একপাশ বেঁকে যাওয়া (Bell's Palsy/Facial palsy) সম্পর্কিত কিছু উল্লেখযোগ্য তথ্যঃ
wikimedia common থেকে ছবিটি নেয়া
- Bells' Palsy/Facial palsy এই রোগটা ভাইরাস ইনফেকশান দিয়ে হতে পারে বলে ধারণা করা হয়। Facial nerve যেটা মুখ-মন্ডলের মাংসপেশীগুলোকে নিয়ন্ত্রণের কাজ করে সেটা আক্রান্ত হয় এক্ষেত্রে।
- প্রতি ১০০০০০ জনে ৩৭ জন এই সমস্যায় আক্রান্ত হয় এমন একটা ডাটা আছে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই (শতকরা ৮৫ ভাগের বেশী) কোন স্পেশাল চিকিৎসা ছাড়াও এটা ঠিক হয়ে যেতে পারে ৪-১২ সপ্তাহে!
- উচ্চ মাত্রার স্টেরয়েড (High dose corticosteriods) মেডিসিন ৭২ ঘন্টার মধ্যে শুরু করতে পারলে তাড়াতাড়ি এবং পুরোপুরি ঠিক হবার সম্ভাবনা বেশী থাকে।
- যদিও ভাইরাস ইনফেকশানের কারণে এটা হতে পারে, এন্টি ভাইরাল (anti viral drugs) ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ আছে। তাই অনেকেই স্টেরয়েড এর সাথে এন্টি ভাইরাল ওষুধ দেয়া রিকমেন্ড করে, অনেকে করে না।
- যেহেতু চোখ বন্ধ হয় না, সেক্ষেত্রে এটার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। রাতে টেপ দিলে হলেও চোখ বন্ধ রাখার ব্যবস্থা করা দরকার। চোখের শুষ্কতার জন্য লুব্রিকেটিং ড্রপ (lubricating eye drop) ব্যবহার করতে হবে।
- নিচের ছোট ভিডিওটা দেখুন। আরো কিছুটা আইডিয়া পাবেন এটা সম্পর্কে।
ওকে। আজকে এ পর্যন্তই। আশা করি কিছু নতুন তথ্য পেয়েছেন আমার পোস্ট থেকে। কোন পরামর্শ বা প্রশ্ন থাকলে কমেন্ট এর মাধ্যমে জানাবেন। ভাল থাকুন।
আল্লাহ হাফেজ
ডা. হাফিজ
ওমান
চেম্বার কথন সিরিজের পূর্ববর্তী পোস্টঃ
কয়েন গিলে (Foreign Body ingestion) ফেলা এক তরুণীর গল্প !
এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশানের রিয়াকশানে (Anaphylaxis) প্রায় হারাতে বসা এক রুগীর গল্প!
বুকে বাতাস জমা (Pneumothorax) এক রুগীর গল্প!
একজন হাউজমেইডের (Housemaid) গল্প যিনি তার চাকরি হারানোর দ্বারপ্রান্তে
ফরনিয়ার গ্যাংগ্রীনে আক্রান্ত এক রুগীর গল্প
পেশাব এবং তলপেটের ব্যথা নিয়ে আসা এক রুগীর গল্প
আমি ডা. হাফিজ। ঢাকার একটা মেডিকেল থেকে ডাক্তারী পাশ করেছি। ২০১৪ সাল থেকেই দেশের বাইরে আছি। শুরুতে ২ দুই বছর ছিলাম মালদ্বীপে। তারপর থেকে ওমানে আছি গত ৭ বছর ধরে। এখানে একটা পলিক্লিনিক এ জি.পি. ডাক্তার হিসাবে কর্মরত আছি বর্তমানে।
My Discord ID: hafiz34#3722
আমি যতটা জানি স্ট্রোক করলে এভাবে মানুষের মুখ বাঁকা হয়ে যায় তবে থেরাপির মাধ্যমে দুই তিন মাস পর কন্ট্রোলে আনা যায়। তবে যাই হোক নতুন একটা বিষয় সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। আর এই বিষয়ে অনেক কিছু জানার সুযোগ হলো আপনার মাধ্যমে। যে বিষয়গুলো আমার কাছে আরো অজানা ছিল।
স্ট্রোক করলে শরীরের একপাশ পারালাইসিসের সাথে সাথে মুখও বাকা হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটা ঠিক স্ট্রোক না। শুধু মুখের এক পাশ বেকে যায়।
এক্ষেত্রেও থেরাপী হেল্প করতে পারে। তবে মেডিসিনের পাশাপাশি।
ধন্যবাদ আমার পোস্টটা পড়ার জন্যে এবং কমেন্ট করার জন্যে।