আমিও ঠিক জানি না, বিজ্ঞাপনকে আসলেই শিল্প বলা যায় কি না।
বিজ্ঞাপনকে শিল্প বলতে অনেকেরই আপত্তি আছে এবং তাদের কাছে বিজ্ঞাপন আসলে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় পণ্য বিক্রি করার একটি কুটিল এবং বুদ্ধিমান কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়। আমিও ঠিক জানি না, বিজ্ঞাপনকে আসলেই শিল্প বলা যায় কি না। তাই ওই বিতর্কে যাবো না, তবে বিজ্ঞাপন শুধুই পণ্য বিক্রির কৌশল, আর কিছু নয় কিংবা আর কিছু করে না, এই ধারণা'টি একটু পুরানো বলে মনে করি। বিশেষত আমাদের মতো দেশে যেখানে জনগোষ্ঠীর ৬৫% এর বয়স ৩০'র কোঠায় এবং popular culture কে (pop-culture) প্রভাবিত করার মতো সিনেমা তার নির্দিষ্ট লক্ষ্য থেকে এখনো অনেক দূরে, আমাদের ঋদ্ধ থিয়েটারও গুটিকতক মানুষকেই শুধু প্রভাবিত করতে পারছে এবং এখনো প্রফেশনাল থিয়েটার হয়ে উঠতে পারেনি, ওদিকে টি, ভি নাটকের অবস্থাও বিশেষ সুবিধার নয়।
এমন অবস্থায় আমরা যদি খুব বেশি নয় গত দশ পনের বছরের দিকে তাকাই (১০/১৫ বছর এই জন্য বললাম, কারণ, এই সময়'টাতেই বাংলাদেশের অর্থনীতি সবচেয়ে গতিশীল হয়েছে এবং আমাদের জনগোষ্ঠীর বড় অংশ'টাই যে তরুণ, তা প্রতিভাত হয়েছে) তাহলে দেখতে পাবো, সামাজিক নানা বিষয়ে বিজ্ঞাপন যেভাবে মানুষকে ভাবিয়েছে অথবা ভাবানোর চেষ্টা করেছে, অন্য কোন সৃষ্টশীল মাধ্যম তা করতে পারেনি কিংবা করার সুযোগ পায়নি। তার মানে এই নয় যে, বিজ্ঞাপন পণ্য বিক্রি না করেই সমাজ উদ্ধারের কাজ করেছে। কিন্তু আধুনিক মানুষকে পণ্য বিক্রির প্রয়োজনেই বিজ্ঞাপনকর্মীদের অনেক বেশি সমাজ সচেতন হতে হয়েছে। আজকের এই ফেসবুক, টুইটারের যুগে, মানুষ অনেক সচেতন এবং সামাজিকভাবে দ্বায়বদ্ধ হয়ে উঠেছে, তাই, এখন আর ধেই ধেই করে করে নেচে গেয়ে পণ্যের কথা বললেই আর পণ্য বিক্রি হচ্ছে না। তাই মানুষের কারণেই বিজ্ঞাপন সংস্থাগুলোকেও হয়ে উঠতে হয়েছে অনেক বেশি সমাজ সচেতন, ভাবতে হয়েছে সমাজ, সংস্কৃতি, ভাষা এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানান খুটি-নাটি বিষয় নিয়ে। এইরকম নানান কারণে বিজ্ঞাপন তরুণ সমাজকে, পপুলার কালচারকে প্রভাবিত করেছে ভীষণভাবে।
আমি বলছি না সব প্রভাবই সুপ্রভাব, দুষ্টু প্রভাবও পড়েছে বটে। কিন্তু কেন যেন আলাপ করতে গেলে বিভিন্ন জায়গায় শুধু দুষ্টু প্রভাবের কথাই শুনতে পাই। অথচ আমি নিজে জড়িত ছিলাম এমন অনেক ক্যাম্পেইন, টি,ভি কমার্শিয়াল, ডিজিটাল ক্যাম্পেইন অথবা ইভেন্টের কথা বলতে পারি যেগুলোর সুপ্রভাব সমাজের নানান স্তরে উপলব্ধ হয়েছে এবং পণ্য বিক্রি কিংবা ব্র্যন্ড বিল্ডিং এর খাতিরেই হয়েছে। 'গ্রামীণ ফোনের একাত্তরের চিঠি', রাজনৈতিক পট পরিবররতনের সময় 'ফ্রুটিকা খেয়ে রাজনীতিবিদের সত্য বলার টি,ভি কমার্শিয়াল, ২১শে ফেব্রুয়ারিতে 'গ্রামীণ ফোনের দুনিয়া কাপানো ৩০ মিনিটের আমতলীর ইভেন্ট' অথবা হালের 'কোকাকোলার নিখোঁজ শব্দের খোজের ডিজিটাল ক্যাম্পেইন' সবগুলোই কিন্তু আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভাষা দ্বারা নিজে প্রভাবিত আবার এই ক্যাম্পেইনগুলোও আবার আজকের জনগোষ্ঠীকে তার ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং ভাষার প্রতি প্রভাবিত করেছে, নতুন করে, নতুনভাবে।
আলাদা করে যদি শুধুমাত্র বিজ্ঞাপনচিত্রের কথা বলি, তাহলে আবার সমাজ-সংস্কৃতিতে বিজ্ঞাপনের অন্য আরেক ধরণের প্রভাবের আলাপ করা যেতে পারে। যেমন ধরা যাক 'গ্রামীণ ফোনের আমারে ছাড়িয়া বন্ধু কই রইলা রে...' বিজ্ঞাপন'টির কথা। এই বিজ্ঞাপনের গল্প, নির্মাণশৈলী, ক্যামেরা কারুকাজ, গ্রামীণ দৃশ্যপট, নানানভাবে আমাদের শহুরে মানুষকে নস্টালজিক করে তোলে এবং দ্রুত গ্রামীণ জীবনের সাথে দূরত্ব তৈরি হতে থাকা শহুরে মধ্যবিত্তের সাথে একটা নতুন মানবিক বন্ধন তৈরি করে বলেও বোধ হয়। একইভাবে বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের জন্য তৈরি করা 'বিউটিফুল বাংলাদেশ' এর টি,ভি কমার্শিয়াল আমাদের বিভাজিত সামাজিক অবস্থানে থাকা বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে একাট্টা করে। ফ্রুটিকা খেয়ে সত্যি কথা বলার মতো হালকা চালের বিজ্ঞাপনও কিন্তু আমাদেরকে সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে তির্যকভাবে তাকানোর অভিপ্রায়কে চরিতার্থ এবং উৎসাহিত করে। এমন আরো হাজার'টা বিজ্ঞাপনের কথা বলা যাবে, যেগুলো সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষদের, বিভিন্ন সামাজিক কারণে ভাবিয়েছে। আমার উদহারণগুলো শুধু আমার জড়িত থাকা বিজ্ঞাপনগুলো নিয়ে কিংবা গ্রে'র বিজ্ঞাপনগুলো নিয়ে, কারণ এইগুলোর দ্বায়ভার আমার। কিন্তু এই মূহুর্তে আমার এশিয়াটিক, বিটোপি, এডকম, মিডিয়াকম, সানের অনেক বিজ্ঞাপনের কথা মনে পড়ছে, যেগুলো সমাজকে নানা ভাবে সুপ্রভাবিত করেছে। তাই আলাপের সময় শুধু ফেয়ার এন্ড লাভলীর কথাই বললে হবে না, ভাল দিক'টার কথাও বলতে হবে, তা না হলে বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনী সংস্থা এবং তাতে কর্মরত হাজার হাজার সচেতন বিজ্ঞাপনকর্মীদের প্রতি অন্যায় করা হবে।
এই স্ট্যাটাসের সাথে জুড়ে দেওয়া ছবিগুলো আমাদের আগামী একটা বিজ্ঞাপনের কিছু স্থিরচিত্র। এবং লক্ষ্য করে দেখবেন, এই ছবিগুলোও কি অদ্ভূতভাবে আপনাকে চিরন্তন বাংলার অপরুপ সৌন্দর্যের কথা মনে করিয়ে দেয়, জীবনানন্দ দাশের কবিতার কথা মনে করিয়ে দেয়। তাই বিজ্ঞাপন যদি শিল্প নাও হয়, শিল্পের সাথে একটা যোগাযোগ যে আছে, তা কি করে অস্বীকার করি বলুন??!!!
copy......... fb / 1082072245273972
This post has received a 2.35 % upvote from @speedvoter thanks to: @akazad.