আমরা কি কখনো কখনো টাকা দিয়ে সম্পর্কের গভীরতা বিচার করে ফেলি ? গল্পটি পড়বেন ।

in #relationship6 years ago

গল্পটি হলো অনিমেষ ও তার বাবার গল্প।অনিমেষ এর বাবা খুবই সামান্য বেতনের একটা চাকরি করে। মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন পায় , তাতেই তাদের সারামাস চালাতে হয়। একটুও বাড়তি খরচ করলে মাসের শেষে খুব কষ্ট করে চালাতে হয়।অনিমেষ র মা একজন গৃহবধূ তাই তিনি কোনো অর্থের সাহায্য করতে পারে না। এদিকে অনিমেষ কলেজের প্রথম বর্ষের ইংরাজি অনার্স এর ছাত্র।অনেক কষ্ট করে তাকে পড়াশুনা শেখাচ্ছে তার বাবা এই আশাতে যে ছেলে বড় হয়ে ভালো চাকরি করবে। কিন্তু অনিমেষ এর কাছে তার বন্ধুদের কে দেওয়া কথা বাবার সাথে সম্পর্কের থেকেও দামি। তার কলেজের সব বন্ধুরা অনেক টাকা হাত খরচে খরচ করে যেটা দিয়ে তাদের সারা মাস চালাতে হয়।

just-one-child-featured.jpg

অনিমেষ ও তার বন্ধুদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চায়। কিন্তু সে কোথায় পাবে এত টাকা ? সে এটা ভাবতে থাকে তার জীবন খুব খারাপ একটা জীবন, সে তার জীবনকে কখনোই পছন্দ করে না। পুজোর সময় তার বাবা তাকে ৪ হাজার টাকা দেয় জামা কেনার জন্য কিন্তু তার কাছে সেই টাকা খুব সামান্য টাকা। সে বলে সেই টাকা দিয়ে তার শুধু জামাই কেনা হবে জুতো কেনা হবে না। তার বাবা আর ও ৪০০ টাকা টেবিলের উপর রেখে চলে যায়। অনিমেষ বলে সেই টাকাতে তার পুজোর কেনাকাটা হবে না , বাড়িতে খুব ঝামেলা করে টাকাটা নিয়ে বারিয়ে যায়। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে! ফ্রেন্ড সার্কেলে কিভাবে মুখ দেখাবো বুঝতে পারছে না।ওদের বলেছিলো দামী জুতোটা কিনবো কিন্তু সেটা তো হলো না। এত কম টাকায় কি করবে সে এটা ভাবতে ভাবতে সামনের একটা দোকানে গেল ও একটা সিগারেট ধরিয়ে অর্ধেক খেয়ে সেটাও ফেলে দিলো।

তারপর রিক্সা ডাক দিলো কাছেই একটা ছোট জামার দোকান আছে সেখানে যাওয়ার জন্য। যেতে যেতে রিক্সাটা জ্যামে আটকে যায়। এমনিতেই মেজাজ গরম তার উপর পচন্ড রোদ আবার রাস্তা জ্যাম।
দেখে ১০ বছরের মতো হবে এমন একটা মেয়ে তার হাত ধরে টানছে! হাতে কতগুলো গোলাপ!

-ভাইয়া,ভাইয়া একটা ফুল নেবেন? মাত্র ১০ টাকা!
-না...লাগবে না।
-নেন না ভাইয়া! একটা গোলাপই তো।নেন,খুব ভালো ঘ্রাণ!
লাগবে না তো।যাচ্ছি মার্কেট,তোর গোলাপ নিয়ে কি করবো?
-ভাইয়া,একটা জামা কিনবো ! নেন না ভাইয়া!
বেশ মায়া লেগে গেল অনিমেষ এর।তারপর ২ টো গোলাপ ২০ টাকা দিয়ে নিয়ে, রিক্সাওয়ালা কে তাড়াতাড়ি যেতে বললো !গরমে মেজাজটা আরো গরম হয়ে যাচ্ছে!

দোকানে গিয়ে দেখি দোকানদার নেই।ওয়েট করতে হবে! বসে পড়লো ,ফোনটা বের করে ফেসবুকে ঘাটতে লাগলো ।ফেসবুকে দেখলো তার অন্য ফ্রেন্ডরা বড় বড় শপিং মলের চেক-ইন দিচ্ছে! এগুলো দেখে মেজাজটা আরো গরম হয়ে গেলো! ফোনটা পকেটে রেখে চুপচাপ বসে আছে।একটু পর দোকানদার আসে! ওর কাছে শার্ট দেখতে চাইলো ! নতুন কিছু শার্ট এসেছে।সেগুলো দেখছিলো।

হঠাৎ ঘাড়টা ঘোরাতে গিয়ে দেখে সেই মেয়েটা দোকানের বাইরে দাড়িয়ে আছে! ভিতরে ঝুলিয়ে রাখা শার্টগুলো দেখছে।কিন্তু অনিমেষ অবাক গেল এটা ভেবে যে,মেয়েটা এই দোকানে কি করছে।এখানে তো শুধু ছেলেদের শার্ট! হয়তো ভুলে চলে এসেছে,বুঝতে পারেনি।সে এটা ভেবে আবার শার্ট দেখতে শুরু করে ।একটু পর দেখে দোকানের এক কর্মচারী ওকে বকাবকি করছে। অনিমেষ শার্টগুলো রেখে বাইরে বের হয়।দেখে মেয়েটাকে খুব করে রাগারাগি করছে!

-এই প্রত্যেকদিন তুই এই জায়গা এসে দাঁড়িয়ে থাকিস কোনো? যেদিন টাকা নিয়ে আসতে পারবি সেদিন আসবি!
-কিন্তু, ততদিনে যদি ওই জামাটা বিক্রি হয়ে যায়? আমার তো ওটাই পছন্দ হইছে!
-হলে হবে,এখন যা ভাগ।তোকে যেনো আর না দেখি এখানে!

কর্মচারীর কথায় কষ্ট পেয়ে মেয়েটা চলে যাচ্ছিলো।অনিমেষ ডাক দিয়ে জানতে চাইলো
-তুমি না বললে জামা কিনবে,এখানে তো সব শার্ট।শার্ট দিয়ে তুমি কি করবে?
-আমি একটা শার্টই কিনবো।ওই যে দেখতেছেননা ঝুলানো আছে,ওই শার্টটা কিনবো।
-কার জন্য?
-আমার বাবার জন্য!
-বাবার জন্য? তুমি এতটুকু একটা মেয়ে, বাবার জন্য শার্ট কিনবে?
-আসলে ৬ মাস আগে বাবা ভ্যান চালাতে গিয়ে ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট করে পায়ে আঘাত পায়! কাজে যেতে পারে না।মা লোকের বাড়ি কাজ করে সংসার চালায়! প্রতিবছর বাবা আমার জন্য নতুন জামা কিনে আনতো।কত খাবার কিনে আনতো।কিন্তু এবার বাবা ঘর থেকেই বের হতে পারে না।তাই ভাবছি এবার আমি ফুল বেঁচে বেঁচে বাবাকে এই শার্টটা কিনে দিবো।বাবার হাসিমুখ দেখলে আমারও খুব ভালো লাগে!

মেয়েটার কথাগুলো শুনে অনিমেষ চোখে জল চলে এল ।এতটা কান্না বোধহয় তার আগে কখনো আসেনি।কি বলবো বা করবো কিছুই ভেবে পাচ্ছে না।মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো। এত ছোট বাচ্চা একটা মেয়ে এত কিছু বোঝে অথচ সে এত বড় হয়েও ইচ্ছামতো টাকা না দেবার জন্য বাবার মুখের উপর এত কথা শোনায়। খুব অমানুষ মনে হচ্ছে তার নিজেকে।নিজের জন্য,নিজের স্টাটাস বজায় রাখার জন্য দামী দামী জিনিস কিনেছি সব সময়।অথচ কখনো ভেবেই দেখিনি একটা মানুষ ১৫ বছর ধরে একই জামা পরে পুজো কাটিয়ে দিচ্ছে! সব সময় আমাকেই কিনে দিতো।
এসব ভাবতে ভাবতে আরো বেশি কান্না আসছিলো!
চোখ মুছে মেয়েটাকে দোকানের ভিতর নিয়ে দোকানদার কে বললো শার্টটা দিতে।তারপর ওকে নিয়ে পাশের মার্কেটে গিয়ে ওর জন্য একটা জামা আর ওর মায়ের জন্য একটা শাড়ি দিনে দিলো ।তারপর অনিমেষ তার বাবার জন্য একটা শার্ট আর মায়ের জন্য একটা শাড়ী!
এগুলো নিয়ে হোটেল থেকে কিছু খাবার কিনে ওর বাড়ির দিকে যায়।
বিদায় নিয়ে চলে আসার সময় ওকে তাদের বাড়িতে আসার জন্য বলে !

বাড়ি ফিরে দেখে বাবা-মা বসে।মা এগিয়ে এসে বলছে,
-বাবা,কেনাকাটা করেছো?একটু পর বাবা একটা প্যাকেট নিয়ে আসে।অনিমেষ কে দেয়, খুলে দেখে,সেই জুতোটা।যেটা সে বন্ধুদের সঙ্গে তুলনা করে কিনতে চেয়েছিল।কিন্তু এত টাকা বাবা কোথায় পেলো।মাকে জিজ্ঞেস করলে মা কিছু বলে না ।বাবাকে জিজ্ঞেস করলে, বাবা বললো বাবার সাইকেলটা বিক্রি করে ২০০০ টাকা হয়েছিল সেটা দিয়ে কিনে দিয়েছে।

কি বলবে বুঝতে পারছিলো না।মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না শুরু করে দিয়েছিলো। তারপর বাবার কাছে ক্ষমা চাইলো। তারপর ব্যাগ থেকে তাদের জন্য কেনা শার্ট আর শাড়ীটা দিলো ও সকলে খুশি হলো। জীবনে এই সে প্রথম বার বুঝতে পারলো কখনো কখনো টাকা দিয়ে সম্পর্কের গভীরতা বিচার করে ফেলি যেটা খুব বড়ো ভুল করি।

Coin Marketplace

STEEM 0.27
TRX 0.11
JST 0.030
BTC 69671.74
ETH 3835.28
USDT 1.00
SBD 3.49